Sponsor

Header Ads

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৯

হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে কেন........??


এমন কোন হিন্দু নেই যে এ প্রশ্নটি
শোনেনি। এ প্রশ্ন যে শুধু অন্য ধর্মের
লোকেরা করেন তাই নয় বরং অনেক
সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও করেন।
আজ তাই আপনাদেরমূর্তি পূজা কি
এবং কেন করা হয় তা সনাতন
দর্শনের আলোকে তুলে ধরব।
বেদে বলা হয়েছে ইশ্বর যেমন অরূপ
তেমনি ইশ্বর স্বরূপ।
এই অরূপ ও স্বরূপ এবং সাকার ও নিরাকার
একি কথা!
তবে বেদে সরাসরি প্রতিমা পূজার
প্রসঙ্গ নেই আবার বিরোধিতাও নেই।
নিচে ব্যাপার টা ব্যাখ্যা করা হলঃ
প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন
দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নাই
বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
হিন্দু শাস্ত্র মতে , ঈশ্বর এক ও
অদ্বিতীয়।সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর
স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর
নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন
স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের
স্রষ্টা।আমাদের প্রাচীন ঋষিগন
বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন
নির্দিষ্ট রূপ নেই(নিরাকার ব্রহ্ম)
তাই তিনি অরূপ,
তবে তিনি যে কোন রূপ ধারন
করতে পারেন কারণ তিনিই বিশ্ব
ব্রহ্মাণ্ডে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
ঋকবেদে বলা আছে, ঈশ্বর
একমেবাদ্বিতীয়ম’- ঈশ্বর এক ও
অদ্বিতীয়।


ঈশ্বর বা ব্রহ্ম (ব্রহ্মা নন)
সম্পর্কে আরও বলা হয়,
অবাংমনসগোচর’ অর্থাৎ
ঈশ্বরকে কথা(বাক), মন বা চোখ
দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না,
তিনি বাহ্য জগতের অতীত।
ঈশ্বর
সম্পর্কে ঋকবেদে বলা আছে-‘একং সদ
বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋক-১/৬৪/৪৬)
অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু
নামে বলে থাকেন।
‘একং সন্তং বহুধন
কল্পায়ন্তি’ (ঋক-১/১১৪/৫) অর্থাৎ
সেই এক
ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
এটা ভালো করে দেখেন যর্জুবেদে কি
বলা হয়েছে,
মহতী কীর্তিতেই যাঁহার নামের স্মরন
হয়,
যাঁহার গর্ভে জ্যোতিস্কমণ্ডলী স্থান
পাইছে
বলিয়া প্রত্যক্ষ, আমাকে তোমা হইতে
বিমুখ করো না- এই রূপ ভাবে যাহার
উপসনা বিধেয় সেই পরমাত্মার কোন
প্রতিকৃতি বা মূর্তি নাই।(যর্জুবেদ ৩২/৩)
এখানে নিরাকার রূপের
কথা বলা হয়েছে।
হ্যাঁ এটা সত্যি ইশ্বরের নিরাকার
রূপের কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতি হয় না।
কিন্তু এখানে ইশ্বরের সাকার রূপের
কথা বলা হয়নি। আর সাকার রূপের
মূর্তি বা
প্রতিকৃতি হয়।
‘দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত’ (ঋক-১০/৭২/৭)
অর্থাৎ দেবতারও পূর্বে সেই
অব্যাক্ত(ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপন্ন
হয়েছে।
ঈশ্বর এক কিন্তু দেবদেবী অনেক।
ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যে কোন
রূপে সাকার হতে পারেন আমাদের
সামনে কারণ তিনি সর্ব ক্ষমতার
অধিকারী। যদি আমরা বিশ্বাস
করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান
তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার
গুনের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক।
সরাসরি ব্রহ্মের প্রতিমা বা মূর্তি না
থাকলেও ব্রহ্মের রূপের বর্ণনা
করেছে উপনিষদঃ
"ব্রহ্মের ২টি রূপ- মূর্ত ও অমূর্ত,
মর্ত্য ও অমৃত, স্থিতিশীল ও
গতিশীল, সত্তাশীল ও অব্যক্ত।"
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২/৩/১)
এই পুরুষের রূপ হরিদ্রারঞ্জিত বসনের
মতো পীতবর্ণ, মেঘলোমের মতো
পাণ্ডুবর্ণ, ইন্দ্রগোপ কীটের মতো
রক্তবর্ণ, অগ্নিশিখার মতো, শ্বেত-পদ্মের
মতো এবং চমকিত বিদ্যুতের মতো।
(বৃহদারণ্যক, ২/৪/৬)
হ্যাঁ এটা সত্যি ইশ্বরের নিরাকার রূপের
কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতি হয় না।
কিন্তু ইশ্বরের সাকার রূপের মূর্তি বা
প্রতিকৃতি হয়।
আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের
নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের
উপাসনার বিধান আছে।নিরাকার
ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই,
থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের
অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন
তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর
যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা
করেন তাঁরা সাকারবাদি। এজন্য
গীতায়
বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ
ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর
প্রাপ্ত হন।তবে নির্গুণ উপাসকদের
কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার
ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের
পক্ষে খুবই ক্লেশকর।
মানুষের মন স্বভাবতই চঞ্চল।
পার্থিবজগতে আমাদের চঞ্চল মন
নানা কামনা বাসনা দিয়ে আবদ্ধ।
আমরা চাইলেই এইকামনা বাসনা
বা কোন কিছু পাবার আকাংক্ষা
থেকে মুক্ত হতে পারি না।
তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা,
স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই
সগুন ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপের
মাধ্যমে।মনে রাখতে হবে আমরা
কখনই ঈশ্বরের বিশালতা বা
অসীমতা কে আমদের সসীম চিন্তা
দিয়ে বুঝতে পারব না।
আর এই জন্যই মূর্তি বা বিগ্রহ
পূজা করা হয়।
এটা অনেকটা গনিতের
সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরা।
আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স
ধরেই হয়ত আমরা গনিতের
সমস্যার উত্তর পেয়ে যাই। অথবা
ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা
কোন কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করি।
কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হল যার দৈর্ঘ,
প্রস্থ ও বেধ নাই কিন্তু অবস্থিতি আছে।
যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু
নয়।অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই
আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের
গভীরতা থেকে হিমালয়ের
উচ্চতা সব মাপতে পারি। আবার
ধরুন ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব
রেখে কল্পনা করি এটা পৃথিবী আবার
দেয়ালের ম্যাপ
টানিয়ে বলি এটা লন্ডন,
এটা ঢাকা এটা জাপান। কিন্তু ঐ
গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী?
অথচ ওগুলো দেখেই আমরা পৃথিবী
চিনছি। তেমনি মূর্তির রূপ
কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল
দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন
বা রূপকল্প।এগুলো রূপকল্প
হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির
করতে সাহায্য করে।
আমেরিকার বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে
স্বামী বিবেকানন্দ মূর্তি পূজার প্রশ্নের
উত্তরে বলেছেন,
"Hindus are not idol-worshiper.
They are ideal-worshipers"
অর্থাৎ হিন্দুরা মূর্তি পূজক নন,
তাঁরা আদর্শের পূজারী। মূর্তি হলো
একটি আদর্শের প্রতীক মাত্র।
কিন্তু হিন্দুরা কখনই সেই মূর্তিকে
ইশ্বর বলে না, সেই প্রতিমা ইশ্বরের
প্রতীক মাত্র।
আমরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র
প্রতীক মনে করি এর বেশি কিছু নয়।
এজন্য পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগন
মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে প্রতিমায়
প্রাণপ্রতিষ্ঠা
করেন অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় দেবতাগন ঐ
প্রতিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেন।আবার
কাঠমাটির প্রতিমা যে ঐ সকল
দেবতা নয় তার প্রমান মেলে পূজার
পর প্রতিমা গুলোকে জলে বিসর্জন
দিয়ে, যদি প্রতিমাকেই ঐ সকল
দেবতা মনে করা হত তাহলে নিশ্চয়
কেউ তা জলে বিসর্জন দিত না।
তাই হিন্দুর দেবমূর্তি পুতুল নয়।
তা চিন্ময় ভগবানেরই প্রতীক।
এজন্য
স্বামী বিবেকানন্দের বলেছেন,
‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু/ কাঠ
মাটি দিয়ে গড়া। মৃন্ময়ী মাঝে
চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা।‘
শুধুমাত্র পরম ঈশ্বরের উপাসনাতেই
ঈশ্বর লাভ হয়।এজন্য গীতায়
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
‘যন্তি মদযাজীনহপি মাম
(গীতা-৯/২৫)
অর্থাৎ একমাত্রআমার ভক্তগণই
আমাকে প্রাপ্ত হন।
মূর্তি বা ভগবত বিগ্রহ প্রতীক
বটে তবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে এটাই
শেষ কথা নয়।সাধনা যাত্রার
প্রারম্ভে শ্রীমূর্তি হতে পারে কিন্তু
সাধনার পরিনতিতে উহা চিন্ময়
সত্তা। প্রতীক রুপটি চিন্ময়
রুপে পরিনতি হলেই পূজা সার্থক হয়।
যিনি একদিন ছিলেন অপরিচিত
লোক – তারই সঙ্গে বহু মেলামেশার
পর যেমন তিনি হয়ে ওঠেন পরম বন্ধু –
সেইরুপ প্রতীক রূপে যে মূর্তির হয়
প্রতিষ্ঠা, ভক্তের অর্চনারফলে তিনিই
হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবান।
আচার্য রামানুজের কথায় ‘
অরচ্চাবতার’।


আচার্য রামানুজেরকাছে একদিন
এক মূর্তি পুজায়"আস্থাহীন ব্যক্তি
এসে উপস্থিত হন।তিনি আচার্যকে
জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্ব ব্যাপী,
তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট
ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি
রেখেছেন কেন? আচার্য বললেন,
আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য
আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম
হতে আমাকে আগুন এনে দিন ,
তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দিব।
ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুণ
নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য
তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এক
খণ্ড দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন?
যা বলেছি তাই আনুন। আগুন
বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর
মধ্যেই আছে। আপনার হাত
ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন
আছে।আপনি আমার জন্য একটু
খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।
আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন,
অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু
আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ
ছাড়া উপায় দেখি না।তখন আচার্য
বললেন, সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত
অগ্নিকে আমার নিকট
আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায়
দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ
সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম
আনতে চাইলে মূর্তিকে আরোপ
ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার
হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল
কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার
পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি,
তেমনি আমার নিকটস্থ এই
ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল
নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময়
ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।নারায়ণ
যেমন অযোধ্যায় এসেছিলেন রাম
রূপে, তিনি আজ আমার
দুয়ারে এসেছেন অর্চচাবতার রূপে।
আচার্যের উক্তিটি জিজ্ঞাসু
ব্যক্তিটির সকল সংশয় দূর করে দিল।
আশা করি সকলে মূর্তি পূজা কি এবং কেন
করা হয় তা বুঝতে পেরেছেন।
আগমশাস্ত্র মতে, "স্থূলমূর্তি"
বা "বিম্বমূর্তি" (মূর্তির শরীর) ও
"মন্ত্রমূর্তি" (মূর্তির শক্তি) এক নয়।
মন্ত্রমূর্তিই কেবল প্রাচীন
মন্দিরগুলিতে পূজিত হয়ে আসছে।
বিম্বমূর্তিতে স্থিত মন্ত্রমূর্তিটিক
ে যথাযথ
অনুষ্ঠান, স্তোস্ত্রপাঠের মাধ্যমেই
পূজা করা সম্ভব।
সর্বশেষ একটি উদাহরন টানতে পারি,
সৎগুরু শিবায়া সুব্রহ্মণ্যস্বামীর
মতে, "এই
ব্যবস্থাটি টেলিফোনের
মাধ্যমে কথা বলার মতো। কেউ
টেলিফোনের
সঙ্গে কথা বলে না;
বরং টেলিফোনের
মাধ্যমে একজনের সঙ্গে আর এক
জনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
টেলিফোন
ছাড়া দূরে থাকা লোকটির
সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব। ঠিক
তেমনি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত
মূর্তির সাহায্য ছাড়া কেউ
দেবতার
সঙ্গে কথা বলতে পারে না।"
আসলে মূর্তি বা প্রতিকৃতি হল
দেবতা বা ইশ্বরের
সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ।
সুতরাং যারা সনাতনিদের
প্রতিমা পূজা কে
পৌত্তলিক বলে তাঁদের দার্শনিক
দারিদ্রতাই প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।
কারণ সনাতন দর্শনেই সাকার ও
নিরাকার উভয় ধরনের উপাসনার
মাধ্যমে ঈশ্বর পূজিত হন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for Comment